ফরমান হোসাইন
নৌকা তৈরীর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাচাঁমাল রোভিং (মোটা সুতা), যা স্থানীয় ভাষায় গাঈনী সুতা নামে পরিচিত। এই সুতার সাহায্যে নৌকার ফাঁকা জায়গাগুলো খুব দৃঢ়ভাবে এঁটে দেয়া হয়। এর আগে গাঈনী সুতা হাতে তৈরি হত। ফলে সুতা তৈরির এই প্রক্রিয়াটি ছিল সময় সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুলও। এছাড়া এই প্রক্রিয়ার রোভিং তৈরির সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিলো সুতার অসম পুরুত্ব।
সম্প্রতি বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের(বুটেক্স) ৪৩তম ব্যাচের পাঁচ শিক্ষার্থী উদ্ভাবন করেন TI-44129 মডেলের রিকার্ড(ReKard) নামের এক মেশিন। যার সাহায্যে গার্মেন্টস শিল্পের ওয়েস্টেজ ফেব্রিক থেকে রিসাইকেলড ফাইবার দিয়ে তৈরী করা যাবে রোভিং (মোটা সুতা)। টিম ইনোভেশন নামের এই গ্রুপের সদস্যরা হলেন আব্দুল ওয়াহাব ফাহিম, হাবিবুর রহমান, সারোয়ার হোসাইন, খালিদ হাসান ও মাহফুজুল হক। পাঁচজনের সবাই ইয়ার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী।
নৌকা তৈরীর খাতে রিকার্ড মেশিন রোভিং (স্থানীয় ভাষায় গাঈনী) সুতা তৈরীকরণের আধুনিকায়ন বলা যেতে পারে। রিকার্ড মেশিনের আগে রোভিং বানানো হতো চরকার মাধ্যমে। যেখানে খরচ এবং জনবল উভয় বেশ প্রয়োজন হতো এবং অসম পুরুত্বের সুতা তৈরী হতো। ফলস্বরূপ নৌকা তৈরীর স্থানীয় শিল্প কারখানা গুলো একইসাথে অসম পুরুত্বের সুতা ব্যবহারে বারবার সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিলো এবং নিজেদের খরচ মিটিয়ে লাভের মুখ দেখতে হিমশিম খাচ্ছিলো । এমন সময়ে রিকার্ড মেশিনের উদ্ভাবন খাত সংশ্লিষ্টদের জন্য স্বস্তির খবর হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে টিম ইনোভেশনের সদস্য সারোয়ার হোসাইনের বলেন,” দীর্ঘ দুই বছর চেষ্টার ফলে এই মেশিন তৈরী করতে সক্ষম হয়েছি।”
টিমের আরেক সদস্য খালিদ হাসান মেশিন তৈরির প্রসেস বর্ণনা করে একটা ইউটিউব ভিডিও বানায়। যা দেখে একটি প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে তাদের সাথে যোগাযোগ করে এবং মেশিন তৈরির সব খরচ তিনি বহন করেন।
“আমরা উনার সাথে চুক্তি করি খুব অল্প টাকায়, আমাদের ধারনা ছিলো এর থেকে কম টাকায় আমরা পারবো, কারন সেকেন্ড হ্যান্ড পার্টস যোগাড় করে অ্যাসেম্বল করবো।” যোগ করেন সারোয়ার হোসাইন।
টিম ইনোভেশনের হাবিব বলেন “কাজ করতে গিয়ে দেখলাম যেহেতু মেশিনের সমস্ত পার্টস সেকেন্ড হ্যান্ড ম্যাটারিয়াল থেকে তৈরী তাই কাজের চ্যালেন্জ ছিলো অনেক বেশী। এ মেশিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পার্টস ক্লথিং সেটাও আমরা স্পিনিং মিলের পুরনো অংশ থেকে জোগাড় করে কাজে লাগিয়েছি”।
টিমের কম্পিউটার ডিজাইনার শাতিল বলেন, “সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং অংশ ছিলো থ্রিডি ডিজাইন করা যেহেতু পুরনো পার্টসের পরিমাপ অনুযায়ী ডিজাইন করতে হয়েছে”। তাছাড়া এমন উদ্ভাবনী কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডিং বাড়ানো দরকার বলে উল্লেখ করেন তারা। শিক্ষকদেরও ভার্সিটি ও ইন্ডাস্ট্রির সাথে সংযোগ স্থাপন করে ছাত্রদের এধরনের কাজে সুযোগ করে দেয়ার আহবান জানান টিমের সদস্যরা।
প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই মেশিনের বাণিজ্যিক উৎপাদন করা সম্ভব বলে জানান তারা। তবে উদ্ভাবনকৃত এই মেশিন কতটা কার্যকরী সে প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খালিদ হাসান বলেন, “এটা আমাদের তৈরীকৃত প্রথম মেশিন হওয়ায় বেশ কিছু ভুল ত্রুটি রয়েছে। পরবর্তী ভার্সনে আমরা সেগুলো সংশোধন করতে পারবো।
শিক্ষার্থীদের এই কাজে সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইস এন্ড কেমিক্যাল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ড. আব্বাস উদ্দীন শায়ক।
শিক্ষার্থীদের এই কাজে বিভিন্ন সময় অনেকেই সহায়তা করেছেন৷ তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন মন্ডল স্পিনিং মিলস লিমিটেডের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ইন্জিনিয়ার মোঃ মমিনুল মতিন (তুষার) ও ওয়ার্কশপের মালিক ফারুক। ইতিমধ্যে তৈরী মেশিনটি উৎপাদনে নিতে সরবরাহ করা হয়েছে চট্টগ্রামের “লিটন হার্ডওয়্যার” নামের স্থানীয় একটি কারখানায়।
Leave a Reply